রেডিয়াম-এর রেডিয়েশন নিয়ে কিছু কথা…
- রেডিয়াম কী?
আমরা যারা হাত ঘড়ি ব্যবহার করে থাকি তারা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছি ঘড়ির সময় সংখ্যা বিভিন্ন রং বিচ্ছুরিত করে। আর এই রং বিচ্ছুরিত করার পেছনের প্রযুক্তি হচ্ছে রেডিয়াম প্রযুক্তি। অর্থাৎ রেডিয়াম এমন এক প্রযুক্তি যা থেকে আলো ঠিকরে বেরোয়। রেডিয়াম একটি তেজস্ক্রিয় রাসায়নিক মৌল। এর পারমাণবিক সংখ্যা ৮৮। এই মৌলিক পদার্থটি আবিষ্কারের মাধ্যমেই প্রথম পারমাণবিক শক্তি সম্বন্ধে মানুষের ধারণা জন্মায়। রেডিয়াম শব্দটি ল্যাটিন শব্দ রেডিয়াস থেকে এসেছে। যার অর্থ হচ্ছে রশ্নি।
- ভৌত ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য সমূহ:
অবস্থা: কঠিন
সাধারণত তাপ ও চাপে ঘনত্ব: 5.5 g/cm3
গলনাঙ্ক: 973K (700°C, 1292°F)
স্ফুটনাঙ্ক: 2010K (1737°C, 1292°F)
গলনের সুপ্ততাপ: 8.5KJ/mol
বাষ্পীভবনের সুপ্ততাপ: 113KJ/mol
পারমাণবিক ভর: 226g/mol
তাপ পরিবাহিতা: (300K) 18.6W/(m.k)
ইলেকট্রন বিন্যাস: 7s2
- ইতিহাস:
সময়টা ছিল ১৮৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর। আইফেল টাওয়ারের শহর প্যারিসের এক ছোট ভাঙ্গাচুরা অস্বাস্থ্যকর কুটির এবং গবেষণাগার থেকে একটি খবর চারদিকে তেজস্ক্রিয়তার মত ছরিয়ে যেতেই চারদিকের বাতাসে আলোচনা ভাসতে লাগলো। বিজ্ঞানমহলে ঠাই নিল এক নতুন স্থলুস্থুল। একটি নতুন মৌল আবিষ্কৃত হয়েছে যা কিনা ইউরেনিয়ামের আলোর চেয়েও কুড়ি গুন অধিক শক্তিশালী আর আলো কাঠ-কয়লা, পাথর, তামা প্রকৃতি কঠিন বস্তুর মধ্যে প্রতিফলিত হওয়ার ক্ষমতা রাখে, যা পদার্থবিজ্ঞানে পূর্বেকার ধারণার মধ্যে রীতিমতো বিপ্লব হয়ে দাঁড়ালো। আর তার পিছনে যেই দুই কান্ডারী তাদের জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন তারা হলেন মহীয়সী মানীয়া ইসক্লোড দোসকা (ইতিহাস যাকে মাদাম কুরি হিসেবে চিনে) এবং তার মহামতি স্বামী প্যাট্রি কুরি। প্রথমবার রেডিয়াম আবিষ্কার করতে গিয়ে গবেষকদের যথেষ্ট ধকল পোহাতে হয়েছিল। বোহেমীয় খনি থেকে প্রাপ্ত ইউরেনিয়ামের অবশেষ নিয়ে কুরির নেতৃত্বে গবেষক দল তাদের সরঞ্জামহীন গবেষণাগারে দীর্ঘ ৪৫ মাস কঠোর পরিশ্রম করে রাত-দিনের হিসেব ভুলে ৮ টন লোহাকে চূর্ন করেছিলেন। তারা প্রায় ১০ হাজার বার আংশিক কেলাসন করেন এবং অবশেষে বহু আকাঙ্ক্ষিত ০.১ গ্রাম রেডিয়াম প্রস্তুত করতে সক্ষম হন। এই পরিমাণটি তার আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর পরিমাপের পক্ষে যথেষ্ট ছিল। মেরি কুরি ১৯০২ সালের ২৮ মার্চ বিবরণ পেশ করে বলেন রেডিয়ামের পারমাণবিক ভর ২২৫.৯ যা বর্তমান মান ২২৬.০২ থেকে খুব বেশি কম নয়। তারা এই ক্লোরাইড যৌগ থেকে রেডিয়াম পৃথক করেছিলেন। মেরি কুরি এবং তার সহগবেষক এ ডেবিয়ের্নে ০.১০ গ্রাম রেডিয়াম ক্লোরাইড বিশিষ্ট দ্রবণকে তড়িৎ বিশ্লেষণ করেন। এর ফলে পারদস্কর হিসেবে পারদ ক্যাথোডে রেডিয়াম সঞ্চিত হয়। পারদস্করটিকে লোহার পাত্রে নিয়ে হাইড্রোজেন প্রবাহিত করা হয় এবং একই সাথে উত্তপ্ত করা হয়। এতে সংকর ধাতু থেকে পারদ মুক্ত হয়ে পাত্রের তলায় রূপার ন্যায় সাদা চকচকে ধাতুর মতো জমা হয়। আর বিশুদ্ধ রেডিয়াম পৃথক হিসেবে পাওয়া যায়।
- বৈশিষ্ট্য ও ব্যবহার:
রেডিয়াম নামক এই অদেখা ভয়ঙ্কর শক্তির বৈশিষ্ট্য হলো, তা মৌলের পরমাণু ভেঙে দিয়ে রশ্মি বিকিরণ করে যা কোন পদার্থকে নিমিষেই ভঙ্গুর করে দিতে পারে। প্রাণীর শরীরকে ছিন্নভিন্ন করতে পারে কোষ এর কার্যকারিতা ভেঙে দিয়ে। প্রকৃতির জন্য যা মারাত্মক হুমকি স্বরূপ। তবে যে ক্ষেত্রে রেডিয়াম সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এনেছে, তা হলো চিকিৎসা। বিশেষ করে ক্যান্সারের মতো মৃত্যুরোগকে গায়েল করতে রেডিয়াম পদ্ধতি তার মুখোমুখি দাড়িয়ে গেল। ফলে ক্যান্সারে আক্রান্ত বিপুল মানুষ আরো কিছুদিন দুনিয়ার বুকে হেঁটে বেড়ানোর সুযোগ পান। এক্ষেত্রে ব্যক্তির আক্রান্ত স্থানে উচ্চশক্তিসম্পন্ন বিকিরণ প্রয়োগ করা হয়। এই বিকিরণ শক্তি ক্যান্সার কোষগেুলোকে মেরে ফেলে, কখনো ক্যান্সার কোষের ডিএনএ নষ্ট করে এর বৃদ্ধি রোধ করে। আমরা রেডিওথেরাপি সম্পর্কে কমবেশি সবাই জানি। সাধারণত উচ্চশক্তিসম্পন্ন এক্সরে ব্যবহার করা হয় রেডিওথেরাপি তে। আক্রান্ত ব্যক্তিকে কয়েক ধাপে রেডিয়েশন থেরাপি প্রয়োগ করার পর কোষগুলো ধীরে ধীরে নষ্ট হতে থাকে এবং এর কার্যক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে। এভাবে একসময় কোষগুলো মারা যায় এবং ক্যান্সারের পরিধি কমতে শুরু করে।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে মেরির এই উদ্ভাবন এক অনন্য ইতিহাস হয়ে রয়েছে। পৃথিবীতে বসবাসরত সকল জাতিগোষ্ঠী মেরিকে কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করেন। সুদীর্ঘ ৪ বছরের সেই চেষ্টায় কুরি দম্পত্তিকে আজ ইতিহাসের স্বর্ণ মুকুট পরিয়ে রেখেছে।
এরকম বিজ্ঞান বিষয়ক আরও লেখা পড়তে আমাদের সাথে থাকুন। ধন্যবাদ