জার্মানদের ভালোবাসার একটা উদাহরণ
কয়েকদিন আগের কথা। সন্ধ্যার দিকে সৌহার্দকে নিয়ে একটু বের হলাম। আমাদের শহরের সাবেক মেয়রপ্রার্থীর বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছি। জার্মান ওই ভদ্রলোকের বাড়ি আপনারা এর আগেও হয়তো দেখেছেন… “জার্মান কৃষকের বাড়িতে একচক্কর”… সম্ভবত এই শিরোনামের একটি ভিডিওতে… ফুলে-ফলে-সবুজে সাজানো সুন্দর এক বাড়ি। বিপত্মীক ওই ভদ্রলোক একাই থাকেন বিশাল ওই বাড়িতে। একমাত্র ছেলে থাকে ডর্টমুন্ড মেইন শহরে।
যা-ই হোক, তাঁর বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দেখি তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। আমি ভাবছিলাম দেখা করবো না। পাশ কাটিয়ে যাবো। দেখা হলে কথা বলবেন আর তাতে করে আমার দেরি হবে। গাড়ি এমনিতেই ওই রাস্তায় ৪-৭ কিলোমিটার (ওয়াকিং স্পিড) গতিতে চালাতে হয়। সুতরাং তিনি আমাকে দেখেই ফেললেন, ‘হালো হাসান’ বলে হাত উঁচালেন। আমি থামলাম কিন্তু গাড়ির ইঞ্জিন অফ করলাম না।
বললেন, ভেতরে আসো, কফিটফি খাই (সাধারণত জার্মানরা এমন অনাহূত আগন্তুককে ভেতরে যেতে বলে না); আমি বললাম আজ না, আরেকদিন আসবো। ঠাণ্ডায় গাড়ির ব্যাটারির অবস্থা খারাপ। অফ করলে হয়তো স্টার্ট দিতে প্রবলেম হবে। ওয়ার্কশপ থেকে বললো, যখনই স্টার্ট দিই যেন কমপক্ষে ১৫-২০ মিনিট চালাই, এতে করে ব্যাটারি চার্জ হয়ে থাকবে। তিনি বললেন, তোমার কি ব্যাটারি লাগবে? লাগলে আমি দিতে পারি। আমি বললাম, না না লাগবে না। ব্যাটারি তো নতুন। জাস্ট আমি গাড়ি চালাই কম তাই এই সমস্যা। তিনি মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে মুচকি হাসলেন, বললেন, বুঝছি ভেতরে না আসার অজুহাত এটা। যাক্ আসতে হবে না কিন্তু বলো যে, তোমার ফ্রিজে কি জায়গা আছে? আমি বললাম, হ্যাঁ আছে কিন্তু কেন? তিনি বললেন, তাহলে একটা মিনিট দাঁড়াও! আমি আসছি…
দেখি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তিনি ফেরত। হাতে বাজারের একটা ব্যাগ। খুলে দেখি তাঁর বাগানের ফ্রোজেন সবজি, ব্যাগভর্তি! সবজির প্যাকেটের গায়ে বিভিন্ন মেয়াদ লেখা মার্কার দিয়ে। তাঁর এই আচরণে আমি রীতিমতো অবাক! এ যেন সন্তানের জন্য অভিভাবকের ভালোবাসা!
দু-চার কথা বলে বিদায় নেবো এমন সময় আবার বলে উঠলেন, ও হ্যাঁ আরেকটু দাঁড়াও… আজই খেত থেকে নতুন আলু তুলেছি… না না দাঁড়াতে হবে না… আমার সাথে আসো! আলু নেবে? আমি বললাম, হুম, তা নেওয়া যায়। কারণ সুপারমার্কেটের আলু একেতো মজা নেই তার ওপর দামও প্রচুর। জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাগ আছে গাড়িতে? আমি বললাম, হ্যাঁ আছে। নিয়ে আসো তাহলে। গ্যারেজে যেখানটায় আলু রাখা সেই টুকরিটা দেখিয়ে বললেন, নাও তোমার যতটুকু ইচ্ছে…
আমি কেজি পাঁচেক নিলাম। বিভিন্ন সবজি আর আলু মিলিয়ে বাজারের বিশাল এক ব্যাগ হলো। আমি আর দেরি না করে বাসার উদ্দেশে রওয়ানা দিলাম, কারণ এর পরদিন সৌহার্দের স্কুল আছে।
সৌহার্দ এ যুগের পোলাপান। মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি 😉 😉 বললো, বাপি আম্মুর সাথে প্র্যাঙ্ক করবা? আমি বললাম, কীভাবে? সে বললো, গিয়ে বলবা, এই নাও বাজার। সস্তা পেলাম তাই সব নিয়ে আসলাম। ও হ্যাঁ, ওই জার্মান ভদ্রলোক সৌহার্দকে একটা চকলেটও দিয়েছিলো। সে সেটা খায় নি, হাতেই ছিলো। বললো এটা আমার হাতে থাকলে আরও বিশ্বাসযাগ্য হবে ব্যাপারটা যে আমরা বাজারে গিয়েছিলাম।
যেই কথা সেই কাজ। বাসায় ঢুকলাম চুপিচুপি। বৌ’র হাতে ব্যাগটা দিলাম। এসব দেখে সে কিছুটা কনফিউজ্ড। ঝাড়ি দিবে কি-না ঠিক বুঝতে পারছে না, কারণ দেখে সুপারমার্কেটের বাজারও মনে হচ্ছে না। বিশ্বাস করানোর জন্য বললাম, তার্কিশ মার্কেট থেকে আনলাম, সস্তায় দিলো তাই সব নিয়ে আসলাম। দেশে থাকতে অফিস থেকে ফেরার সময় গলির মোড়ের মামা যেমন পাম্পপট্টি দিয়ে মায়াময় কথা বলে যা-তা গছিয়ে দিতো তেমন ঘটনা ঘটেছে বলে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। সে পুরাই কনফিউজ্ড! ঝাড়ি মারবে কি-না তখনও ভাবছে… বাইরে গেলেই বাজারে যেতে ইচ্ছে করে না!? আর বাজারে গেলেই এটা-সেটা কিনতে হবে, না!? কনফিউশন আরও বাড়ানো কিংবা কমানোর জন্য সৌহার্দ তার হাতের চকলেটটা উঁচিয়ে ধরলো… এবার দেখি ঝাড়ি চলেই আসলো… বেচারার সাথে আর প্র্যাঙ্ক করা যাবে না… বললাম যাও, বলছি কী হয়েছে, আগে ক’টা আলু সিদ্ধ দাও। অনেকদিন আলুভর্তা খাই না। খেতে খেতে সব বলছি…
অনেকদিন পর এমন ফ্রেশ আর অর্গানিক আলুর সঙ্গে সরিষার তেল, শুকনো মরিচ আর ধনেপাতা দিয়ে আলুভর্তা… নিজেই বানালাম, উফ্! মনে হলো যেন অমৃত!
খাবার খেতে খেতে ভাবছিলাম, কোথাকার কোন্ আমি হাজার হাজার মাইল দূরে এসে কত অজানা-অচেনা মানুষের কি ভালোবাসাই না পেলাম! কতজন কত কথা বলে… জার্মানরা রেসিস্ট, র্যুড… ইত্যাদি ইত্যাদি আরও কত কি…
কিন্তু নিজের জীবন থেকে দেখলাম, ভালোবাসা পেতে হয় ভালোবাসা দিয়ে। মানুষকে ধর্ম-বর্ণের উর্ধ্বে গিয়ে ভালোবাসতে পারলেই তবে আপনি আশা করতে পারেন অন্য মানুষের ভালোবাসা…
ভালোবাসার জয় হোক, মনুষ্যত্বের জয় হোক!
অসাধারণ। আমি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়লাম।হাসান ভাই, আমি কাতারে থাকাকালীন তাদের সাথে আমার খুব সখ্য ছিলো।ইনশাআল্লাহ, আমি চেষ্টা করে যাবো যে এই পৃথিবীর সকল গোত্র সকল ধর্মের মানুষের মাঝে প্রিয় হয়ে থাকতে।