জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন প্রক্রিয়া : শুরু থেকে শেষ

জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কীভাবে আবেদন করতে হয়?— এমন প্রশ্ন থাকে অনেকের মনেই, বিশেষ করে যাঁরা জার্মানিতে উচ্চশিক্ষা চান। কিন্তু অনেকেই জানেন না কীভাবে নিজে নিজে আবেদন করতে হবে। এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের যেন কোনো শেষ নেই। তথাকথিত এজেন্সি নামের দালাল ধরবো না-কি নিজে নিজে আবেদন করতে পারবো? এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খায় অনেকের মনেই।

আপনাকে গ্যারান্টি দিচ্ছি আজকের এই আর্টিকেলটা পড়ার পর আপনার আর কোনো এজেন্সির কাছে দৌড়ানোর প্রয়োজন হবে না। জার্মানির  বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করাটা কঠিন কিছুই নয়।

তবে দালালের খপ্পরে পড়লে এই সহজ বা কথিত ‘কঠিন’ কাজই চরম দুঃস্বপ্নের মতো হয়ে যেতে পারে। তাই এই আবেদন প্রক্রিয়ার শুরু থেকে শেষ সব কিছু ছোট্ট করে এখানে উল্লেখ করার চেষ্টা করবো। এবং আমার বিশ্বাস এ থেকে আপনার কিছুটা নয়, অনেকখানিই উপকার হবে!

জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন প্রক্রিয়া

জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন প্রক্রিয়া তুলনামূলক বেশ সহজ। শুরুতেই এই আবেদন প্রক্রিয়াকে সহজ পাঁচটি  ধাপে বিভক্ত করে দেখা যাক।

ধাপ : ১ (ইউনিভার্সিটির রিকোয়ারমেন্ট)

কোনো ইউনিভার্সিটিতে আবেদন করার আগে দেখতে হবে সেখানে কী চাওয়া হয়েছে। অধিকাংশ ইউনিভার্সিটির প্রধান চাওয়া হচ্ছে প্রিভিয়াস অ্যাকাডেমিক রেকর্ডস, সিজিপিএ, ব্যাচেলরের জন্য এইচএসসির সিজিপিএ, এবং মাস্টার্সের জন্য ব্যাচেলরের সিজিপিএ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মাস্টার্স কোর্সের জন্য ব্যাচেলরে বাংলাদেশি স্কেলে সিজিপিএ ৩.০+ থাকলেই নিরাপদ ধরা হয়। সেই সাথে ২.৫+ নিয়েও মোটামুটি মানের ইউনিভার্সিটিতে অ্যাডমিশন ম্যানেজ করার অনেক উদাহরণ আছে।

পুরোপুরি ইংরেজি ভাষায় কোর্স করতে চাইলে আয়েল্টস (IELTS) স্কোর অবশ্যই দরকারি। আয়েল্টসে ৫.৫ থেকে ৭.৫ এই সীমার মধ্যে স্কোর চাওয়া হতে পারে। মনে রাখা ভালো বিজনেস রিলেটেড সাবজেক্টে কিছু বেশি আয়েল্টস (IELTS) স্কোর চেয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে মিডিয়াম অব ইন্সট্রাকশন দিয়ে অ্যাডমিশন কিছু ইউনিভার্সিটি থেকে ম্যানেজ করা যেতে পারে। আটকে যাবে ভিসায়। ইংরেজি মাধ্যমে যেতে চাইলে অ্যাম্বাসিতে আয়েল্টস স্কোর দেখাতে হবে।

আপনার কোর্স যদি জার্মান ভাষায় হয় তাহলে জার্মান স্কেলে বি১ অথবা বি২ পর্যন্ত সার্টিফিকেট থাকতে হবে। এবং ভিসায় জার্মান ভাষায় প্রশ্ন করা হবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়।

ইউনিভার্সিটি খোঁজা :

ইউনিভার্সিটি খোঁজার জন্য অনেকের কাছে অনেক কিছু প্রয়োরিটি পায়। সহজ কথায় আপনার প্রোফাইল মানে সিজিপিএ/আয়েল্টস যদি খুব ভালো হয় তাহলে অনেক প্যারামিটার দেখে ইউনিভার্সিটি খুঁজতে পারেন। সিজিপিএ কম থাকলে অল্পের মধ্যেই সন্তুষ্ট থাকা ভালো।

ইউনিভার্সিটি খোঁজার জন্য প্রথমেই দেখা উচিত সাবজেক্ট কতোটা ইন্ডাস্ট্রি অরিয়েন্টেড। যেমন : কিছু কোর্স আছে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং। নির্দিষ্ট কোনো ফোকাস নেই। আবার কিছু আছে কম্পিউটার সায়েন্সের সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে।

বুঝাই যাচ্ছে সাইবার সিকিউরিটি একটি নির্দিষ্ট ফিল্ড। এখন ধরা যাক দুইজন পাশ করে বের হলো। জব মার্কেটে ইন্টারনেট সিকিউরিটি বিষয়ক একটা পোস্ট আছে। এই দুইজনের মধ্যে সবার আগে ডিমান্ড পাবে সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে যিনি গ্রাজুয়েশন করেছেন।

যদি পার্ট-টাইম জব করার ইচ্ছা থাকে তাহলে সিটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। সেই সাথে খরচের ব্যাপারটা মাথায় রাখতে হবে। বড় সিটি মানে বেশি বেশি পার্টটাইম জব। আবার খরচাপাতিও বেশি। ইউনিভার্সিটি খোঁজার জন্য সবচেয়ে রিলায়েবল মাধ্যম হচ্ছে ডাড-ওয়েব পোর্টাল (DAAD)

এখানে আপনার প্রোফাইল এবং প্যারামিটার সেট করে দিলে ওই সম্পর্কিত সকল ইউনিভার্সিটি এবং কোর্স লিংক চলে আসবে। আপনার কাজ হচ্ছে সেখান থেকে কাঙ্ক্ষিত খুঁজে নেওয়া।

জার্মান গ্রেডিং ক্যালকুলেটরে সহজেই দেখে নিন আপনার জার্মান সিজিপিএ কত আছে।

ধাপ ২ : (প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস)

জার্মান ইউনিভার্সিটিতে আবেদন দুইভাবে হতে পারে। ইউনিঅ্যাসিস্ট (uni-assist) অথবা সরাসরি ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইট। কোথায় আবেদন করতে হবে সে বিষয়টি আগে নিশ্চিত হতে হবে। জার্মান সব কোর্সে আবেদন এক রকম হয় না। কেউ লেটার অব মোটিভেশন চাইতে পারে, কেউ লেটার অব রেকমেন্ডেশন, কেউবা ডকুমেন্ট অ্যাম্বাসি থেকে সার্টিফাই করাতে বলবে, কেউ নোটারি অথবা কোনো সার্টিফিকেশন চাইবে না। বুঝাই যাচ্ছে কোর্স অনুযায়ী সব আলাদা। ওয়েবসাইট ঘেঁটে অথবা কোর্স-কোঅর্ডিনেটরকে ইমেইল করে এই ডকুমেন্টসের তালিকা জেনে নিতে হবে।

কমপ্লিট অ্যাপ্লিকেশন :

ইউনিঅ্যাসিস্টে (uni-assist) আবেদন করার জন্য সবার আগে অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। সেখান থেকে দরকারি কোর্সের নাম ম্যাচ করে আবেদন করতে হয়। সেই সাথে দরকারি সব ডকুমেন্টের সফট কপি আপলোড করতে হয়। পেমেন্ট দেওয়া এবং হার্ডকপি ডকুমেন্টস পাঠানোর মাধ্যমে আপনার আবেদন নিশ্চিত হবে।

ইউনিভার্সিটিতে সরাসরি আবেদনের সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সফট কপি দিয়ে বা আপলোড করে কাজ শেষ করা যায়। অনেক সময় পেমেন্ট দেওয়ার ঝামেলাও নেই।

হার্ড কপি পাঠানো :

ইউনিঅ্যাসিস্টে আবেদনের জন্য ডকুমেন্টস হার্ডকপি হিসেবে পাঠানো বাধ্যতামূলক। সবার আগে ইউনিঅ্যাসিস্ট থেকে আবেদন কপি ডাউনলোড ও সাইন করতে হয়। সেই সাথে সাপোর্টিং সব ডকুমেন্টস- একসাথে করে পাঠাতে হবে।

মনে রাখা ভালো, ডেডলাইনের অন্তত এক সপ্তাহ আগে ডকুমেন্টস পাঠানো উত্তম। পাঠানোর জন্য ডিএইচএল, ফেডেক্স অথবা অন্য যে-কোন প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করতে পারেন।

ধাপ ৩ : (অ্যাডমিশন / অফার লেটার)

সাধারণত অ্যাডমিশন অফার লেটার পাবার পর ইমেইলে জানানো হয়। অধিকাংশ সময় সেই ইমেইলে অ্যাটাচমেন্ট হিসেবে সফটকপি/স্ক্যানড কপি অফার লেটার পাঠানো হয়। সেই সাথে এক কপি কুরিয়ার করেও পাঠানো হয়।

কাজেই এই কপি পাওয়া মাত্র পরের কাজগুলো শুরু করে দিন। যদি ইমেইলে কোনো স্ক্যানকপি না পাঠানো হয় তাহলে তাদেরকে অনুরোধ জানান। তা না করলে সময় নষ্ট হবে।

অ্যাকোমোডেশন :

অ্যাডমিশন পাবার পর প্রথম কাজই হচ্ছে  অ্যাকোমোডেশন খোঁজা। যতো আগে খুঁজবেন তত কম প্রেসার পড়বে আপনার ওপর। জার্মানি স্টুডেন্ট হোস্টেল ‘studentenwerk’ নামে পরিচিত। পাশাপাশি সব সিটিতেই প্রাইভেট হাউজিং এবং শেয়ারড অ্যাপার্টমেন্ট বা WG থাকে।

ব্লক্ড অ্যাকাউন্ট :

জার্মানিতে পুরো বছরের অ্যাকোমোডেশন খরচ হিসেবে প্রতিমাসের জন্য একটা অ্যামাউন্ট ব্লক্ড করে ব্যাংকে রাখতে হয়। ২০২৩ সালের হিসেবে তা প্রতিমাসে ৯৩৪ ইউরো বা পুরো একবছরের জন্য ১১ হাজার ২০৮ ইউরোর ব্লক্ড অ্যাকাউন্ট করতে হবে। জার্মানিতে উচ্চশিক্ষা বা আউসবিল্ডুং ইত্যাদির জন্য ফিনটিবা (Fintiba), এক্সপ্যাট্রিও, কোরাকল বা  ডয়েচ ব্যাংকের ( Deutsche Bank) ব্লক অ্যাকাউন্ট করা যায়। এদের মধ্যে প্রথম তিনটিই বেশ জনপ্রিয়।

ধাপ ৪ : (ভিসা অ্যাপয়েন্ট)

অ্যাডমিশন/অফার লেটার লেটার পাওয়ার পর পরই ভিসার জন্য ডেট বুকিং দিতে হবে। চাইলে অ্যাডমিশন/অফার লেটার লেটার হাতে আসার আগেও দেওয়া যায়। অনেক সময় ভিসার ডেট নিয়ে খুবই সংকট হয়। যা থেকে বাঁচার জন্য আগে ভাগেই বুকিং দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

ভিসার দরকারি ডকুমেন্টস :

ভিসা আবেদনের জন্য পাসপোর্ট, ছবি, ভিসা ফরম, ব্লক্ড মানি ডিপোজিট, ট্রাভেল হেল্থ ইন্স্যুরেন্স, অ্যাকাডেমিক ডকুমেন্টস থাকতে হবে। সেই সাথে এসব ডকুমেন্টের দুইসেট ফটোকপি ভিসা সাক্ষাৎকারের দিন সাথে নিয়ে যেতে হবে।

ভিসাপ্রাপ্তির সময়কাল :

স্টুডেন্ট ভিসা প্রসেসে সাধারণত ২০-৩০ দিন সময় লাগে। কিছুক্ষেত্রে আরও কম বা বেশি লাগতে পারে। ব্যাচেলর স্টুডেন্টের জন্য ২-৩ গুণ বেশি সময় লাগতে পারে।

ধাপ ৫ : (সর্বশেষ)

সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আপনার ভিসা যথাসময়ে রেডি হয়ে যাবে। উড়াল দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকুন মনে মনে। আপনি আগেভাগেই প্লেনের টিকেট কিনতে পারলে কমের মধ্যে পাওয়া যেতে পারে। নিদেনপক্ষে টিকেট বুকিং বা রিজার্ভ করে রাখতে পারেন।

শীতের ভারী কাপড় বা জ্যাকেট দেশ থেকে না কিনে জার্মানিতে এসেই কেনাই ভালো। জার্মানিতে শীতকালে বেশি বৃষ্টি হয়ে থাকে। তাই আপনার জ্যাকেটটা ভারী, হুডওয়ালা এবং ওয়াটারপ্রুফ হওয়া উচিত।

উপসংহার

আমার মনে হয়, জার্মানিতে স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে আসতে গেলে কী কী ধরনের প্রস্তুতি লাগে, কীভাবে কোর্স খুঁজতে হয় তার সবই এখানে উঠে এসেছে।

লেখাটা পড়ে আপনার যদি মনে হয় কোনোকিছু বাকি রয়ে গেলো তাহলে তা জানাতে পারেন কমেন্টের মাধ্যমে। আর যদি লেখাটি আপনার পছন্দ হয়ে থাকে এবং দরকারি মনে করেন তবে সবার সঙ্গে শেয়ার করতে ভুলবেন না যেন!

6 thoughts on “জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন প্রক্রিয়া : শুরু থেকে শেষ

  • 10/11/2020 at 6:05 AM
    Permalink

    ৩ বছরের ডিগ্রী কমপ্লিট করে মাসটার্স এর জন্য আবেদন করা যাবে নাকি

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *