কেন পড়বেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং?

কোন শহরের রোড দিয়ে যাওয়ার সময় উঁচু উঁচু ভবন দেখে কি আপনার কখনও মনে হয়েছে এগুলো কীভাবে সম্ভব হয়েছে? কোনো ব্রিজের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় কি মনে হয়েছে এগুলো কীভাবে এতো লোড নেয়, কেমনেই বা পদ্মাসেতুর মতো এত বড় একটি সেতু নদীর এতো স্রোতের মাঝেও নির্মাণ করা হচ্ছে। কীভাবে হার্ডিংব্রিজ ১০০ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও টিকে আছে, এটা কি ভেবেছেন কখনও? উন্নত বিশ্বে আকাশছোঁয়া ভবন বা টাওয়ারের ছবি দেখে মনে কি প্রশ্ন জাগে নি এগুলো কীভাবে মাটির ওপর এভাবে দাঁড়িয়ে আছে, ভেঙ্গে পড়ে যাচ্ছে না…!

এসব বানাতে যাদের অবদান সব থেকে বেশি তারা হল সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। বলা যায়, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং না থাকলে এতো উন্নত সভ্যতা আমরা পেতাম না, আমরা এতো উন্নত রাস্তাঘাট, সেতু, ভবন কল্পনাও করতে পারতাম না। আজকের এই লেখায় আমি জানাব সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে। কেন পড়বেন এই বিষয় নিয়ে এবং কোথায় পড়বেন।

সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মূলত বিভিন্ন নির্মাণ কৌশল যেমন ভবন, সেতু, রাস্তা, বাধ, স্তম্ভ ইত্যাদি নির্মাণ কৌশল এবং নির্মাণ পরবর্তী রক্ষণাবেক্ষণ পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হয়। তাছাড়া একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারকে জরিপ ও প্রকল্প ব্যবস্থাপনার কাজও করতে হয়। তাছাড়া বাড়ি-ঘর, দালান-কোঠা, রাস্তাঘাট, ফ্লাইওভার, উঁচু টাওয়ার, এয়ারপোর্ট, পানির পাইপলাইন, বর্জ্য নিষ্কাশন ও রিসাইক্লিং সিস্টেম, ভূমিকম্পের কারণ ও প্রতিরোধ ইত্যাদি বিষয়সমূহ নিয়ে কাজ করা হয় সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে।

সিভিল ইঞ্জিনিয়ারদের কাজ কী?

পরিকল্পনা, ডিজাইন এবং রক্ষণাবেক্ষণ করার কাজ করে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার জরিপের কাজ করে থাকে এবং প্রযুক্তিগত প্রতিবেদন দেয়, এমনকি প্রকল্প ব্যবস্থাপকের কাজও করে থাকে।

সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পরিসর

যেহেতু সময়ের সাথে সাথে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার এর পরিসর বৃদ্ধি পাচ্ছে তাই এর অনেক শাখা বের হয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল স্ট্রাকচারাল, জিওটেকনিক্যাল, ট্রান্সপোর্টেশন, হাইড্রলিক, এনভায়রনমেন্টাল ইত্যাদি ।

সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের গুরুত্ত্ব

দিনকে দিন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার এর গুরুত্ব বেড়েই চলছে। বর্তমানে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার আগুন নিয়ন্ত্রণ নিয়েও কাজ করে। প্রকৌশল বিজ্ঞানের মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো শাখা হলো সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং। পানি, বাতাস এবং মাটি পরিশোধনের বিভিন্ন উপায় নিয়েও কাজ করে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার।

সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রধান শাখাসমূহ

সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রধান ৭টি শাখা আছে। নিচে সেসব সংক্ষেপে বর্ণনা করা হল।

স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং

বাড়ি, হোটেল, পার্ক, ব্রিজ, বিল্ডিং ইত্যাদির উপরে নিজস্ব ভার বা বাইরের ভার প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ে কাজ করে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়াররা। তাছাড়া বাতাস, পানি, ভূমিকম্প, তাপমাত্রাসহ অন্যান্য প্রভাব থেকে রক্ষার জন্য সিমেন্ট, বালি, রি-ইনফোর্সমেন্ট, কাঠ, অন্যান্য উপাদানের সমন্বয়ে সঠিক ডিজাইন করা হলো এই শাখার কাজ।

এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং

পরিবেশ তথা বাতাস, মাটি, পানির ধূষণ রোধ, বিশুদ্ধকরণ ইত্যাদি করা এই শাখার কাজ। বর্তমানে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, বর্জ্য, মল ইত্যাদি অপসারণ এবং বিশুদ্ধকরণ করা নিয়ে কাজ করে এই শাখা।

জিওটেকনিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

প্রায় সকল সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং শাখাতেই এর ব্যবহার আছে। কারণ বেশিরভাগ স্ট্রাকচার মাটির উপর অবস্থিত। মাটি বা পাথরের এর উপর স্ট্রাকচার, এদের বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব নিয়ে আলোচনা করে এই শাখাটি। ভূগর্ভের সিপেজ, ‍ভূমিকম্পের প্রভাব, স্থিতিশিলতা ইত্যাদি নিয়ে কাজ করে এই শাখাটি। বাঁধ, রিটেইনিং ওয়ালের ফাউন্ডেশন ইত্যাদির মাটি পরীক্ষা করা এই শাখার কাজ।

ওয়াটার রিসোর্স ইঞ্জিনিয়ারিং

পানি আমাদের জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। আবার এই পানি আমাদের মরণও ডেকে নিয়ে আসে। পানিসম্পদ প্রকৌশল পানির ভৌত অবস্থা নিয়ে কাজ করে। বন্যা, শহরের-কারখানা-সেচ-এর পানি সরবরাহ, নদীভাঙন রোধ, নদীর শাসন ইত্যাদি বিষয়ে কাজ এবং ডিজাইন করে থাকে। হাইড্রলিক পাওয়ার, বাঁধ, খাল ইত্যাদি নিয়ে কাজ করে এই শাখাটি।

ট্রান্সপোর্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিং

কোনো সমাজের উন্নতি উপর নির্ভর করে তার যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর। মানুষ, পণ্য ইত্যাদি পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা, ডিজাইন, সমস্যা, সমাধান নিয়ে কাজ করে ট্র্যান্সপোর্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিং। অল্প রাস্তায় অধিক পরিবহন সুবিধা, দুর্ঘটনা কমানো, খরচ কমানো, দ্রুত পরিবহণ ইত্যাদি নিয়ে কাজ করে এই শাখাটি।

কন্সট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং

এই শাখাতে কাজ করা হয় যে কীভাবে একটি কাঠামো গঠন করতে হবে। অর্থের ব্যবহার, সময়ের সংক্ষেপন, প্রয়োজনীয় মালামাল-যন্ত্রপাতি ইত্যাদির যোগান ও তাদের ব্যবহার , কাঠামো গঠনের পদ্ধতি নিয়ে কাজ করা হয় শাখাতে।

আরবান ও কম্যুনিটি প্লানিং

নগরায়ণ এবং শহর পরিকল্পনা করা নিয়ে কাজ করা হয় এই শাখাতে। একটি গোষ্ঠী বা জোটে কী কী লাগতে পারে এবং কীভাবে লাগাতে হবে তা নিয়ে গবেষণা ও আলোচনা করা হয় এই শাখাতে।

চাহিদা

সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের চাহিদা পূর্বেও সবসময় ছিল, এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। এদেশে এখন অসংখ্য Real Estate বা construction/consultation ফার্ম আছে, যেগুলোতে প্রচুর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং দরকার হয়। এছাড়াও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারদের সরকারি চাকরির সুযোগ অন্যান্য ইঞ্জিনিয়ারদের তুলনায় অনেক বেশি হয়ে থাকে। অধিক জনবসতি আর নগরায়ণ ও আধুনিকায়নের এই যুগে সিভিলের চাহিদা দিনকে দিন বাড়ছে।

ভবিষ্যত

উন্নয়নশীল দেশ হওয়ায় সিভিলের চাহিদা ভবিষ্যতে আরও বৃদ্ধি পাবে। পৃথিবী ধ্বংসের আগ পর্যন্ত নির্মাণ কাজ যেমন চলতেই থাকবে, পুরকৌশলীদের চাহিদাও ঠিক সেদিন পর্যন্ত থাকবেই এটা নিশ্চিত।

সহায়ক গুণাবলি

বলবিদ্যায় ভালো দখল, ড্রয়িং, ডিজাইন কনসেপ্ট, পরিশ্রমী, দূরদর্শিতা প্রভৃতি গুণ থাকতে হবে।

কর্মক্ষেত্র

১. সরকারি বিভিন্ন বিভাগ যেমন সড়ক ও জনপদ বিভাগ, জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর, গণপূর্ত বিভাগ, দুর্যোগ-ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর, আবহাওয়া অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন অধিদপ্তর প্রভৃতিতে প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়
২. বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলায় নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করা
৩. বিভিন্ন নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ যেমন রাজউক, কেডিএ, সিডিএ প্রভৃতিতে প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োগ পাওয়া
৪. রিয়েলএস্টেট কোম্পানি, বিভিন্ন ডেভলপার কোম্পানি, Consultancy ফার্ম, বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (NGO)-তে কাজ করা
৫. সামরিক বাহিনীরর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর-এ নিয়োগ পাওয়া
৬. বিভিন্ন গবেষণা ইন্সটিটিউটে কাজ করা
৭. সরকারি ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করা
৮. PWD, BIWTA, BIWTC, BRTC, WASA, PDB ইত্যাদিতে কাজ পাওয়া
৯. GrameenPhone, Banglalink-সহ অন্যান্য মোবাইল কোম্পানিতে কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করা।

স্কলারশিপ ও উচ্চশিক্ষা

ভালো ফলাফল এবং IELTS স্কোর থাকলে খুব সহজেই পেয়ে যেতে পারেন স্কলারশিপ নিয়ে বিভিন্ন দেশের নামকরা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার সুযোগ। প্রাইভেট হোক আর পাবলিক, একটু চেষ্টা করলে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে স্কলারশিপ পাওয়া সম্ভব। এ ছাড়া দেশের মধ্যে বুয়েট, চুয়েট, কুয়েট, রুয়েট, IUT, MIST, UAP, SUB, IUBAT, AUST ইত্যাদি ইউনিভার্সিটি দিচ্ছে MSc করার সুযোগ। এছাড়াও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টপমেন্ট থেকে অনেকেই IBA-MBA করছে, এছাড়াও আছে Dhaka University-তে EMBA।

সম্ভাবনার দ্বার সবই খোলা, শুধু ব্যাপার হচ্ছে আপনি কীভাবে নিচ্ছেন আর কীভাবে নিজেকে গড়ে তুলছেন…

কোথায় পড়বেন

বাংলাদেশের প্রায় সব প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েই সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ রয়েছে। আমি এখানে শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো উল্লেখ করছি যেখান থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে BSc করতে পারবেন।

১. বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)

২. ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট ) [শুধুমাত্র ডিপ্লোমা ব্যাকগ্রাউন্ডদের জন্যে]

৩. খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট)

৪. রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট)

৫. চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)

৬. শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (সাস্ট)

৭. মিলিটারি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (MIST)

এছাড়াও কিছু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। পড়তে পারেন কোনো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েও। অন্যদিকে সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ রয়েছে চারটি। এগুলো নতুন প্রতিষ্ঠান হওয়ায় অনেকের কাছেই এখনও অপরিচিত।

১. ময়মনসিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। (এখনও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কোনো ব্যাচ বের হয় নি)
২. সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (এখনও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কোনো ব্যাচ বের হয় নি)
৩. বরিশাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (এখনও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কোনো ব্যাচ বের হয় নি)
৪. ফরিদপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ।

পরবর্তী লেখায় আমি এসব ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের রিভিউ দিব eGalTube-এর ওয়েবসাইটে। সেজন্য eGalTube-এর সাথেই থাকুন। আর এই লেখাটি যদি ভালো লেগে থাকে তাহলে সবার সঙ্গে শেয়ার করতে ভুলবেন না যেন! সেই সঙ্গে আপনার সুচিন্তিত মতামতও প্রত্যাশা করছি, লেখাটি কেমন হলো কিংবা কোনো ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতির কথাও জানাতে পারেন নিচের কমেন্ট বক্সে…

Sabbir Hasan Monir

I am a student of Civil Engineering. I have a proactive attitude and find positive ways to simulate and engage with people.

2 thoughts on “কেন পড়বেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং?

  • 16/11/2020 at 8:45 AM
    Permalink

    Subject Review

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *