দিল্লির পথে পথে… (প্রথম পর্ব)

“মামা যাবেন কই?”, “এ মামা এ মামা…”, “কমলাপুর, গাবতলী, সায়েদাবাদ? মামা কই?” ~ সকাল সকাল ধানমন্ডি শংকরের সিএনজি চালকদের এমন হাঁকাহাঁকির ঠ্যালাতেই আধোঘুমের ঝিম ধরা ভাবটা কেটে গেলো। বেশ বয়স্ক এক চালক মামাকে দেখলাম করুণ চোখে চেয়ে আছে। তার চাহনিই জানান দিচ্ছে, যৌবন হারিয়েছে – এখন পরিবারে দুটো ভাত জুটিয়েই যেনো শেষ বিদায়টুকু জানাতে পারে। আজকাল Uber, Pathao, Shohoj এর আরামদায়ক আর সহজ ভ্রমণের জন্য তাদের ব্যবসাটা বলা যায় রাস্তায় নামতে বসেছে।

যাকগে, ইন্টার্ন্যাশনাল ফ্লাইটের জন্য প্রায় ৪ ঘণ্টা আগে চেক ইন করা লাগে বলে আমি Uber Moto তে রাইড নিয়ে দ্রুত চললাম ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দিকে। সকাল ১০ টায় ফ্লাইট হওয়ায় বাধে যতসব বিপত্তি! তবে, সকাল সকাল রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী জ্যাম না বাঁধায়, এ যাত্রায় বেঁচেই গেছি বলা যায়। পৌঁছে, আম্মুকে বিদায় জানিয়ে দ্রুত বোর্ডিং পাস নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম ইমিগ্রেশন কাউন্টারের লাইনে।

 

 

“কোথায় কোথায় যাবেন ভারতে? যে হোটেলে বুকিং দিয়েছেন, সেটা দিল্লির কোথায়?” – ইমিগ্রেশন অফিসারের এমন প্রশ্নে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেছিলাম, কেননা যশোরের বেনাপোল ল্যান্ড পোর্টে সাধারণত এরকম প্রশ্ন করেনা। আর অনেকেই এজেন্ট দিয়ে ভিসা করিয়ে নেন বিধায়, এমন প্রশ্নে তাদের বেশ সমস্যাই হতে পারে। তো, সব তথ্য দিলাম, আমার ডিপার্চার সিল দিয়ে দিল পাসপোর্টে, আমি যেয়ে বসলাম ওয়েটিং লাউঞ্জে। ফ্লাইট ডিলে ছিল না, বেল্টে বোর্ড হওয়ার পরই এনাউন্স করে দিল, Flight No. BS201 এর যাত্রীদের যেতে হবে ৬ নাম্বার গেটে। সেখানেই অপেক্ষা করছে ঢাকা থেকে কোলকাতা গামী, ইউএস-বাংলার বোয়িং ৭৩৭ মডেলের উড়োজাহাজটি। এনাউন্সমেন্টের পর যেনো মনের চাঞ্চল্য আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেলো! যে যত যাই বলুক, সমতলের বাঙ্গালীর উড়োজাহাজ চড়ে অম্বর দৃষ্টির প্রেম কখনওই কমবে না। আর এজন্য বোর্ডিং এর সময় ই উইন্ডো সিট চেয়ে নিয়েছিলাম। 😋

 

 

ভ্রমণে আমার সহযাত্রী ছিলেন কোলকাতার এক বাঙ্গালি বাবু; শ্বশুর বাড়ী নড়াইলে। কলেজ স্ট্রিটে নাকি তার মস্ত বড় একটা বইঘর আছে। আর আমি একজন ইঞ্জিনিয়ার হওয়াতে বোধহয় তার সাথে রসায়নটা সেভাবে ঠিক জমে উঠলো নাহ। তবে কষ্টটা হলো, এপার বাংলায় শ্বশুরবাড়িতে তার জামাই আদরের গল্পটা মাত্র যখন শুরু করলেন, তখনি ফ্লাইট ক্যাপ্টেইন বেশ ভারি কণ্ঠে এনাউন্স করেদিলো, “কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা অবতরণ করতে যাচ্ছি, কোলকাতার নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। আপনারা সিটবেল্ট বেঁধে নিন। আমাদের সাথে ভ্রমণের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। আশা করছি আপনাদের সাথে আবার ভ্রমণসাথী হতে পারব”। তাই আর কথা না বাড়িয়ে, বাকি কফিটা দ্রুত শেষ করতে তোরজোড় শুরু করে দিলেন। আর জানিয়ে রাখি, ঢাকা থেকে কোলকাতা যেতে সাধারণত ৩০ থেকে ৪০ মিনিট লাগে। নেমে ইমিগ্রেশন শেষ করে দ্রুত চলে এলাম বিমানবন্দরের বাহিরে। দমদমের বুকে তখন কাঠ ফাটা রোদ! উফ! তাও, সিম কেনা লাগবে… নাহলে সামনের দিনগুলোতে ঝামেলা আছে। বিদেশীদের সিম কিনতে হলে পাসপোর্ট প্রয়োজন হয়, আর সিমটার মেয়াদ থাকে সাধারণত ৬ মাস। ওয়েটিং লবিতে ফিরে, লাগেজ গুছিয়ে নিয়ে বসতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো, “Flight No. 6E66 Air Indigo from Kolkata to New Delhi is Delayed”!

 

 

মেজাজ টাই খারাপ হয়ে গেলো। ধুচ্ছাই!! ১২টার ফ্লাইট করা হলো ৪:৩০ এ। ভেবেছিলাম দিল্লিতে নেমেই ঢুকবো চাঁদনিচকে, পুরা প্ল্যানটাই মাটি! তবে কষ্টের মাঝে একটা শান্তি ছিল, ফ্লাইট ডিলে হওয়ায় এয়ার ইন্ডিগো তাদের যাত্রীদের জন্য কমপ্লিমেন্টারি লাঞ্চের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। লাঞ্চে ছিল প্লেইন রাইসের উপর ২ টা বাটার মাখানো বাংলা রুটি, বুটের ডাল, পনিরের তরকারি আর আস্ত পনির। পাশের ছবিতে নিশ্চয় দেখতে পারছেন।টেস্টের কথা বলতে গেলে, ডালটা বেশ মজার হলেও পনির ছিল একদম জঘন্য! সাথে অবশ্য তারা দমদমের মজুমদার বাবুর কালোজামও দিয়েছিল, তাই আর যাইহোক, তৃপ্তির ঢেঁকুর ঠিকই তুলেছিলাম।

 

 

উফ! প্রায় ৩ ঘণ্টা টানা ফ্লাইট শেষে অবশেষে পৌছালাম দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী ইন্টার্ন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। গোধূলির তখন প্রায় লগ্ন, যখন আমি মেট্রোতে উঠলাম। আগেই অনলাইনে হোটেল বুকিং দিয়ে রেখেছিলাম কারোল বাঘের একটি হোটেলে। ৯৫০ রুপি প্রতিরাতের ভাড়া হওয়ায় ভেবেছিলাম বেশ সস্তায়তেই মনে হয় হোটেল পেলাম, পরে ঘোর ভাঙে যখন পুরান দিল্লির ভাসান্তকুঞ্জ তে গেলাম। সেখানে হোটেল ভাড়া প্রায় অর্ধেক! তবে সেখানে নিরাপত্তা ততটা ভাল না। হোটেলে চেক ইন করে বাহিরে এলাম সে রাতেই। ভ্রমণ ক্লান্তির জন্য খুব বেশি ভাল লাগছিলো না, তাই খুব বেশি দূরে না যেয়ে পাশেই হনুমান মন্দিরের সামনে থেকে প্যাক করে আনলাম ১ প্যাক চিকেন বিরিয়ানি, ১টা বিসলারি, ১টা থাম্বস-আপ। আহ! লম্বা লম্বা বাসমতী চালের মধ্যে সেদ্ধ  মশলায় যে কি টেস্ট লাগে! তবে,একটা জিনিস খেয়াল করলাম, কারলবাঘ এলাকায় খুব বেশি জন সমাগম নেই। বেশ চুপচাপ ই বলা যায়। যাকগে, পেটপুজা শেষ, এখন ঘুমানোর পালা! 😴

চিকেন বিরিয়ানি, থাম্বস আপ, বিসলারি নিয়ে দিল্লির হোটেলে

‘চায়ে লিজিয়ে, চায়ে। গারাম চায়ে’ বলতে বলতে মাথাটা খেয়ে নিচ্ছিলো ছোট ৭/৮  টা ছেলে, ইন্ডিয়া গেটের সামনে। ওহ হ্যাঁ, আজ সকালে সবার আগে চলে এসেছি, ইন্ডিয়া গেট দেখতে। আসার আগেই অবশ্য সকালের নাস্তা সেরেছি পাহাড়গঞ্জ হনুমান মন্দিরের সামনে। সেখানের রুটি আর কালা ডালের টেস্ট এর সামান্য কথাতে বলে বোঝানো সম্ভব নাহ! এক কথায় অসাধারণ!! এরপরে সোজা চলে এসেছি দিল্লি গেটের সামনে। বলিউড সিনেমাগুলোতে যেমনটা দেখি, মোটেও এমন না জায়গাটা। চারিদিকে হকার, পানিপুরি বিক্রেতা, খেলনা ওয়ালাতে ভরা চারিদিক। বলিউডের ডিরেক্টরদের এজন্য প্রশংসা করাই লাগে, কিভাবে কিভাবে তারা কাস্টিং এর সময় পুরো জায়গাটা পরিষ্কার করে ফেলে! বাপরে বাপ! আর বাস্তবে একদম নোংরা। মনে হলো আমি ঢাকা উদ্যানের মধ্যে মেবি ভুল করে ঢুকে গেছি! হা হা হা। তবে আর যাই বলেন, জায়গাটার মাহাত্ম্য অনেক! ১৯১৪ থেকে ১৯২১ সালের মধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মারা যাওয়া ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির ৭০ হাজার সৈন্যদের স্মরণে তৈরি এই স্থাপনা। এর দেওয়ালের প্রতিটা অংশে খোদাই করা তাদের নাম! আর যাই বলেন ভাই, ভারতীয়দের দেশপ্রেম যতই দেখি, ততই তাজ্জব হয়ে যাই আমি! ইন্ডিয়া গেটের ঠিক বিপরীত পাশেই রয়েছে ‘রাষ্ট্রপতি ভবন’। যদিও কাছাকাছি যেতে পারিনি। কি যেনো একটা অনুষ্ঠান ছিল সেদিন।

কালা ডাল আর রুটি

 

সুরেশ আংকেল আমাকে সব দেখাতে দেখাতে নিয়ে যাচ্ছেন গাফফার মার্কেটের দিকে। কারোল বাঘের পাশেই নাকি মার্কেট টা। খুব ইচ্ছা ছিল পাঞ্জাবি পাগড়ি কেনার, খুঁজে আর পেলাম নাহ। তবে সুরেশ আংকেলকে ধন্যবাদ দিতেই হয়, তিনি অনেক অলিগলি চিনিয়েছেন আমাকে। ওহহো, সুরেশ আঙ্কলের পরিচয়টাতো দেওয়া হয়নি, তিনি দিল্লির একজন রিক্সা ড্রাইভার। দিল্লির রিক্সা বলতে আমাদের দেশের সিএনজি যেটাকে বলে। বেশ বয়স তার। প্রায় ২৮ বছর আগে রাজস্থান থেকে দিল্লিতে পাড়ি জমিয়েছেন তিনি, কিছুটা স্বচ্ছল জীবনের জন্য। তিনি সাধারণত পাশের পাকিস্তান, আফঘান, ইরান, শ্রিলংকা আর পশ্চিমা সাদা চামড়ার যাত্রী বেশি উঠিয়েছেন। পূর্বের কোনোদেশ হিসেবে আর বাংলার যাত্রী হিসেবে আমিই ছিলাম তার ২৮ বছরের জীবনে প্রথম! এতেই বুঝলাম, দেশের মানুষ আসলে কোলকাতা আর চেন্নাই এর হাসপাতালগুলি ছাড়া বলা যায় ভারতের অনেক কিছুই চিনেনা। কথায় আছেনা? ‘বাঙ্গালি বাবুর পকেট ফাঁড়া কি চাট্টিখানি কথা নাকি?’ সেদিন পুরোটা কাটিয়ে দিলাম গাফফার মার্কেটের আনাচ কানাচ ঘুরে। ভাল লাগার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল, গাফফার মার্কেটের মধ্যে ‘Rajshahi Silk’ নামের একটা দোকান দেখে। প্রথমে দেখে মনে হলো, ভুলভাল দেখছি মনে হয়। হয়ত Rajasthan লেখা। কিন্তু ঘোর কাটিয়ে বুঝলাম, নাহ যা দেখছি, সত্যিই দেখছি। বিদেশভূমে এমন কিছু দেখলে যে কি ভাল লাগে, সে অনুভূতি বলে বোঝানো সম্ভব নাহ! 😅

রাত গড়াতেই ফিরে এলাম হোটেলে। ফেরার পথে নিয়ে নিলাম একদম কমন ইন্ডিয়ান ফুড, ইয়েলো ডাল আর বাটার নান। এতো মজার আর চুইং টেস্ট! যা অসম্ভব সুন্দর টেস্ট।

 

কাল দেখতে বের হবো লাল কিলা – ভাসান্ত কুঞ্জ – চাঁদনি চক; ততক্ষণ আমাদের সাথেই থাকুন…

 

আমার আরও লেখা পড়তে পারেন;

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *