থ্রিডি প্রিন্টিং : প্রযুক্তি দুনিয়ার এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন

ইতিহাস: মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম কোথায় প্রিন্টিং-এর যাত্রা শুরু হয় তা নিয়ে রয়েছে বহু সমালোচনা। তবে চীনে প্রথম প্রিন্টিং-এর ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। তারা কাঠের ব্লক খোদাই করে কাপড় ছাপার কাজ শুরু করেছিল। ব্লকে গলিত মোম কাপড়ে লাগিয়ে বিভিন্ন নকশা তৈরি করা হতো। তখন প্রিন্টিং-এ রঙের ব্যবহারও শিখেছিল  তারা। সেই প্রাচীন থেকে আজ পর্যন্ত প্রিন্টিং দুনিয়ায় নিয়মিত যুক্ত হয়েছে নানা মাত্রা। এরই ধারাবাহিতায় থ্রিডি প্রিন্টিং হতে যাচ্ছে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় পরিবর্তন। ১৯৮৪ সালে চার্লস ডব্লিউ চার্লস ডব্লিউ হাল আধুনিক থ্রিডি প্রিন্টারের আবিষ্কার করেন।আজকের প্রিন্টিং মূলত প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক ব্যবস্থা। 

যেভাবে কাজ করে: এ পদ্ধতিতে কম্পিউটার সফটওয়ার ব্যবহার করে কোনো বস্তুর ত্রিমাত্রিক আকার দেওয়া হয়। প্রথমে বস্তুটির ত্রিমাত্রিক ছবি স্ক্যান করে তা কম্পিউটার সফটওয়ারে প্রসেস করে থ্রিডি মডেলের উপযোগী করা হয়। এক্ষেত্রে সফটওয়ারের সাহায্যে বস্তুর নকশায় প্রয়োজনমত পরিবর্তন করা যায়। এরপর একটি প্রিন্টার বস্তুটির বাস্তবিক রূপ ফুটিয়ে তোলে। তবে নিশ্চয়ই কোনো কাগজে কালি দিয়ে নয়। থ্রিডি প্রিন্টারের কাঁচামাল হিসেবে সাধারণত তরল প্লাস্টিক পলিমার, কাগজ, মোম, গুঁড়ো এবং আধুনিক সংস্করণে সিরামিক ও স্টিল ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। একটি সরু নজেলের মাধ্যমে  তরল পদার্থ স্তরে স্তরে সাজিয়ে কাঙ্ক্ষিত বস্তুর রেপ্লিকা তৈরি করা হয়। প্রথম দিকে এসব প্রিন্টারের অতি উচ্চমূল্য থাকলেও এখন তা মানুষের হাতের নাগালে আসতে শুরু করেছে। 

 

ব্যবহার: বর্তমানে ব্যবসায়িক কাজে এমনকি ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য থ্রিডি প্রিন্টারের ব্যবহার শুরু হয়েছে। জীবনদানকারী কিডনি থেকে জীবন কেড়ে নেওয়া বন্দুক, কৃত্রিম হাত-পা, অলংকার, প্রকাণ্ড গাড়ি-বাড়ি সবক্ষেত্রে রয়েছে এর ব্যবহার। এর সাহায্যে এখন একই মডেলের গয়নার শত শত রেপ্লিকা তৈরি করা যায় খুব সহজে এবং অল্প সময়ে। প্রাচীন ভাস্কর্যের নিখুঁত রেপ্লিকা বানানো সম্ভব। প্রয়োজনীয় মেটারিয়াল ব্যবহার করে আস্ত গাড়ি তৈরি করা সম্ভবপর হয়েছে। BMW, Rolls Royce এর মতো প্রতিষ্ঠান এরইমধ্যে কাজ শুরু করেছে। গাড়ি শিল্পে থ্রিডি প্রিন্টিং-এর ব্যবহার উপযোগী করে তুলতে পারলে মাত্র কয়েক হাজার ডলারে পাওয়া যাবে নিজস্ব গাড়ি। চীনে ইতিমধ্যে বিশালাকৃতির প্রিন্টার দিয়ে বাড়ি-ঘর নির্মাণ করা শুরু হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে থ্রিডি প্রিন্টিং আমাদের জীবনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। বর্তমানে হাত পা, ত্বক, হাড়, কান, কিনডি ইত্যাদির মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রিন্ট করা হচ্ছে ল্যাবে। ফলে অক্ষম ব্যক্তিরা পাবে পূর্ণাঙ্গ জীবনের সাধ। এছাড়া স্টীমসেল গবেষণায় মাইক্রো অরগান তৈরির জন্য থ্রিডি প্রিন্টারের ব্যবহারের কথা ভাবা হচ্ছে যা সম্ভব হলে চিকিৎসাবিজ্ঞান আরো এক ধাপ এগিয়ে যাবে। বায়োটেক খাদ্যের উত্তরোত্তর গবেষণায় এখন ঘরে বসেই তৈরি করা যাবে প্রাণির মাংস। আর এসব সিনথেটিক ফুড প্রিন্ট করতে সাহায্য করবে থ্রিডি প্রিন্টার। কার্বন নিসঃরণ কমাতে সিনথেটিক ফুড তৈরির ব্যাপক গবষণা শুরু হয়েছে এবং তা অনেক দূর এগিয়েছে। বিখ্যাত ব্রান্ড KFC তাদের বিখ্যাত চিকেন নাগেট কৃত্রিমভাবে উৎপাদনের জন্য রাশিয়ার একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি করেছে। উল্লেখ্য ল্যাবে তৈরি এসব খাদ্য মূল খাদ্যের মতই স্বাদ ও পুষ্টিগুণ সম্পন্ন। বরং অতিরিক্ত তেল চর্বি সরিয়ে এবং অন্যান্য উপাদান যোগ করে বাড়ানো যেতে পারে এর গ্রহণযোগ্যতা। দৈনন্দিন জীবনে অনেক কাজে থ্রিডি প্রিন্টারের ব্যবহার লক্ষ করা যায় যা ভবিষ্যতে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। ধরুন আপনার সন্তানকে দোকান থেকে একটা দামি খেলনা গাড়ি কিনে দিলেন।  অথচ মুভিতে দেখা ডাইনোসরকেই খেলার সাথী হিসেবে পেতে তার আগ্রহ। আর আপনিও চট করে একটা টি-রেক্স এর ত্রিমাত্রিক মডেল ডাউনলোড করে কিছুক্ষণের মতো প্রিন্ট করে নিয়ে আসলেন। প্রতিদিন এক মগে কফি খেতে না চাইলে নিজের ইচ্ছামত নতুন একটা ডিজাইন করে নিলেন। এছাড়া শোবার ঘরটা সাজাতে বিভিন্ন জিনিশ না কিনে নিজের তৈরি করে অনেকটা খরচ কমিয়ে দিলেন। এভাবে ভবিষ্যতে প্রতিটি ক্ষেত্রে থ্রিডি প্রিন্টার আমাদের জীবনকে সহজ ও আরামদায়ক করে দিবে; পাল্টে দিবে জীবনযাত্রার ধরন।

তবে থ্রিডি প্রিন্টারের কিছু অসুবিধেও রয়েছে। যেমন এটিএম কার্ড নকল করে ব্যক্তিগত তথ্য চুরি হতে পারে। আবার প্রিন্ট করা প্লাস্টিকের বন্দুক বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে ব্যবহৃত হতে পারে যা কিনা মেটাল ডিটেক্টরে ধরা পড়ে না।

 

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে থ্রিডি প্রিন্টিং-এর ভবিষ্যৎ: উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশে থ্রিডি প্রিন্টিং প্রযুক্তির প্রবেশ কিছুটা দেরীতে হলেও এর ব্যবহার শুরু হয়েছে। তবে পর্যাপ্ত জ্ঞান, দক্ষতা, নতুন প্রযুক্তি গ্রহণের মানসিকতা ইত্যাদির অভাবে বাংলাদেশে থ্রিডি প্রিন্টিং-এর যথাযথ বিকাশ হচ্ছে না। অন্যদের মতো তাল মিলিয়ে বাংলাদেশে এর বিকাশ ঘটলে তা বৃহদার্থে উপকারে আসবে। এদেশে প্রতিদিন বহু মানুষ মারা যায় কেবল সঠিক সময়ে সঠিক অঙ্গদাতার অভাবে। এছাড়া নানা দুর্ঘটনায় অঙ্গহানির মতো ঘটনাতো আছেই। এমন দরিদ্র দেশে এসব ক্ষেত্রে থ্রিডি প্রিন্টিং ব্যবস্থাই কম খরচে সবচেয়ে কার্যকর উপায়ে সমাধান করতে পারে। এছাড়া ইন্ডাস্ট্রিয়াল কাজে আমাদের মত জনবহুল দেশে কম সময়ে, কম খরচে বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন করে বিপুল চাহিদা মেটানো যেতে পারে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীমহল যেনো এই সেক্টরে বিনিয়োগ করে সেজন্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। এছাড়া যেসব উদ্যোক্তারা এটা নিয়ে কাজ করছেন তাদের আরো উৎসাহী করা ও প্রয়োজনে আর্থিক সাহায্য করতে হবে। জনগণের হাতের কাছে এই প্রযুক্তি পৌঁছে দিতে হবে। সর্বোপরি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও উন্নত গবেষণার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।

বলা হয়ে থাকে ভবিষ্যতে যেসব প্রযুক্তি বিপ্লব বয়ে আনবে তার মধ্য থ্রিডি প্রিন্টার অন্যতম। ভবিষ্যতের কলকারখানার রোবটগুলোর স্থান দখল করবে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত থ্রিডি প্রিন্টার। আগামীর চিকিৎসাক্ষেত্রে লিডিং প্রযুক্তিগুলোর একটি হবে এই থ্রিডি প্রিন্টিং। তাই সার্বিক উন্নতির কথা চিন্তা করে থ্রিডি প্রিন্টিং-এর মত নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে আমাদের এখন থেকেই পারদর্শী হয়ে উঠতে হবে।

 

Pronab

জীবন কেবল প্রতিযোগিতার জন্য না মানব জীবন বৃক্ষের পরিপক্ব ফল স্বরূপ যা মহান মানবতার জন্য উৎসর্গিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *