এইচএসসির পর জার্মানিতে ব্যাচেলর : স্টেপ বাই স্টেপ গাইড
জার্মানি উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিশ্বজুড়ে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি দেশ। বিশেষ করে প্রযুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং বিজ্ঞান শিক্ষায় দেশটির সুনাম আন্তর্জাতিক। জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশিরভাগ কোর্সই বিনামূল্যে বা ন্যূনতম খরচে পড়ার সুযোগ থাকে, যা অনেক দেশেই বিরল। এছাড়া, জার্মানির শক্তিশালী অর্থনীতি, বিশ্বমানের গবেষণা সুযোগ, এবং ইউরোপের কেন্দ্রে অবস্থানের কারণে এটি উচ্চশিক্ষার্থীদের জন্য আদর্শ। কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা হলো:
- নিম্ন খরচে উচ্চমানের শিক্ষা : জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে টিউশন ফি খুবই কম, এমনকি বেশিরভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্পূর্ণ ফ্রি।
- বিশ্বমানের শিক্ষা : জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশেষ করে প্রযুক্তিগত এবং বৈজ্ঞানিক শিক্ষায় সেরা।
- গ্লোবাল ক্যারিয়ার সম্ভাবনা : জার্মান ডিগ্রিধারীরা আন্তর্জাতিক চাকরি বাজারে চাহিদাসম্পন্ন।
- ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের জন্য সহায়তাপূর্ণ পরিবেশ : জার্মানির সমাজ সংস্কৃতি শিক্ষার্থীদের জন্য বন্ধুসুলভ এবং সহনশীল।
- পোস্ট স্টাডি ওয়ার্ক পারমিট : ডিগ্রি সম্পন্নের পর দুই বছর জার্মানিতে কাজ করার সুযোগ পাওয়া যায়, যা ক্যারিয়ার গঠনে সহায়তা করে।
ধাপ ১ : পাসপোর্ট তৈরি এবং ডকুমেন্টস যাচাই
প্রথম কাজ হলো আপনার পাসপোর্ট তৈরি করা। পাসপোর্টে দেওয়া আপনার নাম, জন্মতারিখ এবং পিতামাতার নাম অবশ্যই আপনার অন্য নথিপত্রের সাথে মিলিয়ে নিন। যদি কোনো অমিল থাকে, তা সংশোধন করে নিতে হবে।
ধাপ ২ : প্রাথমিক শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন
আপনার এসএসসি এবং এইচএসসি’র সার্টিফিকেট ও ট্রান্সক্রিপ্ট প্রস্তুত রাখুন। এরপর, বাংলাদেশের যেকোনো H+ অনুমোদিত পাবলিক/প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে আপনার ব্যাচেলরের প্রথম ২৫% ক্রেডিট সম্পন্ন করতে হবে। H+ ইউনিভার্সিটি চেক করতে এই লিংকে যান। বেশিরভাগ শিক্ষার্থী দ্রুত ২৫% ক্রেডিট সম্পন্ন করার জন্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় পছন্দ করেন।
HSC-এর পর কেন ২৫% ক্রেডিট সম্পন্ন করতে হয়?
বাংলাদেশে ১২ বছর স্কুলিং শেষে শিক্ষার্থীরা এইচএসসি পাস করেন। কিন্তু জার্মানিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি ব্যাচেলর কোর্সে ভর্তি হতে শিক্ষার্থীদের ১৩ বছরের স্কুলিং থাকতে হয়। এই ঘাটতি পূরণের জন্য বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বছরের ২৫% ক্রেডিট বা এক বছর পূর্ণ করতে হয়। এটা জার্মান শিক্ষাব্যবস্থার একটি শর্ত, যাতে শিক্ষার্থী জার্মান শিক্ষাব্যবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে এবং তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা পূর্ণাঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয়।
স্টেপ ৩ : কোন সেশনে আবেদন করবেন তা ঠিক করুন
জার্মানিতে বছরে দুইটি সেশনে ব্যাচেলর কোর্সে ভর্তি হওয়া যায়:
- সামার সেশন: সাধারণত ক্লাস শুরু হয় এপ্রিল মাসে, এবং এর জন্য আবেদন শুরু হয় অক্টোবর থেকে।
- উইন্টার সেশন: ক্লাস শুরু হয় অক্টোবর মাসে, এবং এর জন্য আবেদন শুরু হয় এপ্রিল থেকে।
এখন জার্মান এম্বাসিতে ভিসা ইন্টারভিউর জন্য দীর্ঘ ওয়েটিং পিরিয়ড থাকায় (২৪-২৬ মাস পর্যন্ত), আপনার যাত্রা শুরু করতে হবে খুব আগেভাগে। তাই অন্তত ২৪-২৬ মাস পূর্বেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নিতে হবে। উল্লেখ্য, অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে কেবল পাসপোর্ট থাকলেই চলবে।
স্টেপ ৪ : কোর্স এবং বিশ্ববিদ্যালয় খোঁজা
আপনার পড়াশোনার বিষয়ে এবং আগ্রহের উপর ভিত্তি করে উপযুক্ত কোর্স খুঁজে বের করুন। কিছু গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবসাইট আছে যেখানে আপনি সহজেই কোর্স এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিস্তারিত তথ্য পেতে পারেন:
- DAAD (German Academic Exchange Service): DAAD ওয়েবসাইট জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সম্পর্কে বিশ্বস্ত তথ্য প্রদান করে। এটি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ একাডেমিক নেটওয়ার্ক।
- My German University: MyGermanUniversity ওয়েবসাইটেও আপনি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং কোর্স সম্পর্কে তথ্য পাবেন। এখানে কোর্সের তথ্য, যোগ্যতা, ডেডলাইন, এবং ভাষাগত প্রয়োজনীয়তা (IELTS/German language) সব পাওয়া যায়।
স্টেপ ৫ : আবেদন প্রক্রিয়া
প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস
- পাসপোর্ট
- SSC সার্টিফিকেট এবং ট্রান্সক্রিপ্ট
- HSC সার্টিফিকেট এবং ট্রান্সক্রিপ্ট।
- ব্যাচেলর ডিগ্রী সার্টিফিকেট এবং ট্রান্সক্রিপ্ট
- মিনিমাম পাসিং গ্রেড।
- মিডিয়াম অফ ইন্সট্রাকশন সার্টিফিকেট (MOI)
- রিকোমেন্ডেশন লেটার। (২ জন-আলাদা আলাদা টিচার থেকে)
- IELTS সার্টিফিকেট। (মিনিমাম ওভারঅল স্কোর ৫.৫-এম্বাসি রিকোয়ার্মেন্ট)
- ইউরোপাস সিভি
- মোটিভেশন লেটার
- জব এক্সপেরিয়েন্স সার্টিফিকেট। (যদি থাকে)
জার্মানিতে উচ্চশিক্ষার জন্য আবেদন করার প্রক্রিয়া বেশ কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়। আপনার যাত্রাকে সহজ করতে এই প্রক্রিয়াটি সুন্দরভাবে অনুসরণ করা যেতে পারে।
কোর্স এবং বিশ্ববিদ্যালয় বেছে নেওয়া :
আবেদন করার আগে প্রথমেই আপনাকে আপনার পড়াশোনার ক্ষেত্র এবং আগ্রহের ভিত্তিতে উপযুক্ত কোর্স এবং বিশ্ববিদ্যালয় বেছে নিতে হবে। এই কাজটি করার জন্য আপনি DAAD এবং MyGermanUniversity ওয়েবসাইট ব্যবহার করতে পারেন। এখানে আপনি আপনার ফিল্ডের বিভিন্ন কোর্স খুঁজে পাবেন এবং প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিস্তারিত তথ্য, যেমন: ভাষাগত দক্ষতা, ডেডলাইন, যোগ্যতা ইত্যাদি জানতে পারবেন।
ডেডলাইন যাচাই করা :
প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কোর্সের আলাদা আলাদা ডেডলাইন থাকে। তাই আপনাকে আবেদনের আগেই কোর্সের ডেডলাইন খুব ভালোভাবে দেখে নিতে হবে। জার্মানিতে প্রধানত দুইটি সেশনে ভর্তি কার্যক্রম পরিচালিত হয়:
- সামার সেশন (April): আবেদনের সময়সীমা অক্টোবর-জানুয়ারির মধ্যে।
- উইন্টার সেশন (October): আবেদনের সময়সীমা এপ্রিল-জুলাইয়ের মধ্যে।
আবেদনের মাধ্যম নির্বাচন :
জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করার জন্য প্রধানত দুটি মাধ্যম রয়েছে:
- Uni-Assist এর মাদ্ধমে: এটি একটি সেন্ট্রালাইজড প্ল্যাটফর্ম, যার মাধ্যমে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করা যায়। Uni-Assist আপনার একাডেমিক ডকুমেন্ট এবং যোগ্যতা প্রাথমিকভাবে যাচাই করে।
- সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ের পোর্টালের মাধ্যমে: কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি তাদের নিজস্ব পোর্টাল থেকে আবেদন করা যায়।
Uni-Assist-এর মাধ্যমে আবেদন :
Uni-Assist হলো এমন একটি কেন্দ্রীয় প্ল্যাটফর্ম যা বেশিরভাগ জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আবেদন প্রক্রিয়া পরিচালনা করে। এখানে আপনার আবেদন দুটি ধাপে সম্পন্ন হয় :
অনলাইন অ্যাকাউন্ট তৈরি এবং আবেদন ফর্ম পূরণ করা :
Uni-Assist-এর ওয়েবসাইটে একটি অ্যাকাউন্ট তৈরি করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে আবেদন ফর্ম পূরণ করতে হবে। এখানে আপনি একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে পারবেন।
ডকুমেন্টস আপলোড করা এবং পেমেন্ট সম্পন্ন করা :
আবেদন ফর্ম পূরণ করার পর আপনার সমস্ত প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস (যেমন: এসএসসি, এইচএসসি সার্টিফিকেট ও ট্রান্সক্রিপ্ট, পাসপোর্ট, IELTS সার্টিফিকেট ইত্যাদি) স্ক্যান করে আপলোড করতে হবে। Uni-Assist আপনার আবেদন মূল্যায়ন করবে এবং যোগ্যতা নির্ধারণ করবে।
ডকুমেন্টস ডাকযোগে পাঠানো :
কিছু ক্ষেত্রে Uni-Assist আপনাকে আপনার মূল ডকুমেন্টস বা নোটারাইজড কপি তাদের ঠিকানায় ডাকযোগে পাঠাতে বলতে পারে। এটি আপনি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করছেন তার উপর নির্ভর করে।
আবেদন ফি প্রদান করা :
Uni-Assist-এর মাধ্যমে আবেদন করতে হলে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আবেদন ফি ৭৫ ইউরো এবং প্রতিটি অতিরিক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ৩০ ইউরো ফি দিতে হয়। পেমেন্ট সম্পন্ন করতে পারেন ক্রেডিট কার্ড, PayPal বা ব্যাংক ট্রান্সফারের মাধ্যমে।
সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ের পোর্টালের মাধ্যমে আবেদন :
কিছু জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ে Uni-Assist ছাড়াই সরাসরি তাদের নিজস্ব পোর্টালের মাধ্যমে আবেদন করা যায়। এই ক্ষেত্রে সাধারণত আপনাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে আবেদন ফর্ম পূরণ করতে হবে এবং সরাসরি সেখানে ডকুমেন্টস আপলোড করতে হবে।
VPD (Vorprüfungsdokumentation):
কিছু বিশ্ববিদ্যালয় সরাসরি আবেদন করার সময় VPD ডকুমেন্ট চেয়ে থাকে। এটি Uni-Assist থেকে প্রাপ্ত একটি ডকুমেন্ট যা আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতা যাচাই করে এবং নিশ্চিত করে যে আপনি আবেদন করার যোগ্য কিনা। VPD পেতে হলে প্রথমে Uni-Assist-এ আবেদন করতে হবে এবং তারা আপনার শিক্ষাগত ডকুমেন্ট যাচাই করে VPD প্রদান করবে।
ডকুমেন্ট প্রস্তুতি :
আপনার আবেদন প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো সব প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস সঠিকভাবে প্রস্তুত রাখা। সাধারণত আবেদনের জন্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টসমূহ নিম্নরূপ:
- এসএসসি এবং এইচএসসি সার্টিফিকেট এবং ট্রান্সক্রিপ্ট (নোটারাইজড কপি হতে হবে)
- ব্যাচেলরের প্রথম ২৫% ক্রেডিট ট্রান্সক্রিপ্ট
- IELTS সার্টিফিকেট (প্রয়োজনে TOEFL বা অন্যান্য ইংরেজি দক্ষতার প্রমাণ)
- পাসপোর্টের কপি
- সিভি (ইউরোপাস ফরম্যাটে)
- মোটিভেশন লেটার
- রেকমেন্ডেশন লেটার (সাধারণত ২টি, শিক্ষক বা প্রফেসর থেকে)
- পাসপোর্ট সাইজ ফটো
- জার্মান ভাষার সার্টিফিকেট (যদি প্রাসঙ্গিক হয়)
আবেদন জমা দেওয়া এবং নিশ্চিতকরণ :
আবেদন জমা দেওয়ার পর আপনাকে আবেদন জমা দেওয়ার কনফার্মেশন (confirmation receipt) প্রদান করা হবে। আবেদন পর্যালোচনা করে বিশ্ববিদ্যালয় আপনার যোগ্যতা যাচাই করবে এবং তাদের সিদ্ধান্ত জানাবে। Uni-Assist-এর মাধ্যমে আবেদন করলে, আপনার আবেদন প্রাথমিকভাবে যাচাই করা হবে এবং তারপর তা সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হবে।
অফার লেটার প্রাপ্তি :
যদি আপনার আবেদন গ্রহণ করা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আপনাকে একটি অফার লেটার প্রদান করা হবে। এটি আপনি ইমেইল বা ডাকযোগে পাবেন। অফার লেটার পাওয়ার পর পরবর্তী ধাপ হলো এনরোল হওয়া এবং ভিসার ইন্টারভিও এর জন্য প্রস্তুতি নেয়া।
ব্লক অ্যাকাউন্ট তৈরি করা :
ভিসা প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো ব্লক অ্যাকাউন্ট তৈরি করা, যেখানে আপনাকে জার্মানিতে থাকার প্রথম বছরের জন্য খরচের নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে। ব্লক অ্যাকাউন্টে প্রায় €11,904 ইউরো জমা রাখতে হয়, যা থেকে আপনি প্রতি মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ উত্তোলন করতে পারবেন।
ভিসার জন্য আবেদন :
অফার লেটার পাওয়ার পর, আপনি জার্মানির জন্য স্টুডেন্ট ভিসা এর জন্য আবেদন করতে পারবেন।
ভিসার জন্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট:
- অফার লেটার
- পাসপোর্ট
- বায়োমেট্রিক ছবি
- ব্লক অ্যাকাউন্ট। (প্রায় ১২,০০০ ইউরো)
- স্বাস্থ্য বীমার প্রমাণ
- অন্যান্য ডকুমেন্টস। (যেমন : শিক্ষাগত যোগ্যতার ডকুমেন্ট)
সমগ্র প্রক্রিয়াটি সঠিকভাবে সম্পন্ন করলে, জার্মানির মতো আন্তর্জাতিক শিক্ষার স্বর্গরাজ্যে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব। এই যাত্রার প্রতিটি ধাপে সতর্ক পরিকল্পনা, ধৈর্য এবং সঠিক দিকনির্দেশনা আপনার সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।
আউসবিল্ডিং নিয়ে এরকম একটা প্রক্রিয়া চাই